শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:১৮ অপরাহ্ন

আমার ছেলে জানে না ফলের স্বাদ কেমন, গাজার দুর্ভিক্ষ বর্ণনায় এক মা

গত পাঁচ মাস ধরে আমরা কোনো আমিষ খাইনি। আমার ছোট ছেলের বয়স চার বছর। কিন্তু সে জানেই না যে ফলমূল আর সবজি দেখতে কিংবা খেতে কেমন হয়। কথাগুলো বলছিলেন গাজা শহরে পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাসরত ৪১ বছর বয়সী নারী রীম তৌফিক খাদার।

গাজার দুর্ভিক্ষে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, দুর্ভিক্ষের ঘোষণা অনেক দেরিতে এসেছে কিন্তু তবুও এটা গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ-সমর্থিত এক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকার কিছু অঞ্চলজুড়ে দুর্ভিক্ষের ঘোষণার পর সেখানকার বাসিন্দারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ভয়াবহ ক্ষুধা কীভাবে তাদের শরীরে প্রভাব ফেলছে।

জাতিসংঘ বলছে, গাজার সহায়তা প্রবেশের ক্ষেত্রে ইসরায়েল ব্যাপকভাবে বাধা দিচ্ছে। তবে ইসরায়েল এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। গাজাজুড়ে যে অনাহার চলছে, সেকথাও ইসরায়েল অস্বীকার করেছে যা ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী, শতাধিক মানবিক গোষ্ঠী ও জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।

শুক্রবার জাতিসংঘ-সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) বলেছে, গাজা সিটি ও আশপাশের এলাকায় সম্পূর্ণভাবে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে, গাজা উপত্যকার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এখন ক্ষুধা, চরম দারিদ্র্য ও মৃত্যুর মতো বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

ছয় সন্তানের মা রাজা তালবেহ ২৫ কেজি ওজন হারিয়েছেন। গাজা শহরের জেইতুন এলাকায় তার বাড়ি ছিল। কিন্তু এক মাস আগে তিনি তা ছেড়ে চলে এসেছেন। এখন তিনি সমুদ্রের ধারে একটি অস্থায়ী তাঁবুতে থাকছেন।

তার শরীর গ্লুটেন মানে শস্য জাতীয় খাবার সহ্য করতে পারে না। তাই বাজারে বা আশেপাশে তার খাওয়ার মতো খাবার খুঁজে পাওয়াটা এখন কঠিন বিষয় হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, যুদ্ধের আগে একটি দাতব্য সংস্থা আমাকে গ্লুটেন-মুক্ত খাবার পেতে সাহায্য করতো। কারণ ওই খাবার কিনে খাওয়া আমার সাধ্যের বাইরে ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমার যা দরকার, আমি তা বাজারে পাই না। আর পেলেও কিনতে পারি না। প্রতিদিন বোমাবর্ষণ, বাস্তুচ্যুত জীবন, গরম ও শীত থেকে রক্ষা করতে পারে না এমন এক তাঁবুতে এভাবে থাকা, এর ওপর আবার দুর্ভিক্ষ, এগুলো কি যথেষ্ট নয়?

২৯ বছরের রিদা হিজেহ জানান, তার পাঁচ বছরের মেয়ে লামিয়ার ওজন ১৯ কেজি থেকে নেমে সাড়ে দশ কেজি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, যুদ্ধের আগে লামিয়ার কোনো রোগ ছিল না। সবকিছুই হয়েছে কেবল দুর্ভিক্ষের কারণে। একটি শিশুর খাওয়ার মতো কিছুই নেই। কোনো সবজি নেই, ফল নেই।

তিনি আরও বলেন, লামিয়া এখন পা ফোলা, চুল পড়া ও স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছে। সে হাঁটতে পারে না। আমি বহু ডাক্তারের কাছে গিয়েছি, ক্লিনিক-হাসপাতাল ঘুরেছি। তারা সবাই বলেছে, আমার মেয়ে অপুষ্টিতে ভুগছে। কিন্তু তারা কেউ কিছু দেয়নি। না চিকিৎসা, না কোনো সহায়তা।

ইউকে-মেড নামের একটি ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থার হয়ে গাজায় কাজ করছেন ব্রিটিশ নার্স ম্যান্ডি ব্ল্যাকম্যান। তিনি বলেন, মাতৃত্বকালীন, প্রসবের আগে ও প্রসবপরবর্তী অবস্থায় যেসব মায়েরা ক্লিনিকে আসেন, তাদের ৭০ শতাংশের শরীরে অপুষ্টি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে জন্ম নেওয়া শিশুদের আকার ছোট হচ্ছে এবং তারা বেশ নাজুক।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস আক্রমণ করে। তখন ইসরায়েলে এক হাজার ২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস। সেই হামলার প্রতিক্রিয়ায়ই ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান চালানো শুরু করে। এখন পর্যন্ত সেখানে ৬২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত ২৭১ জন দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে মারা গেছে, যাদের মধ্যে ১১২ জন শিশু। গাজা শহরের বাসিন্দা আসিল বলেন, পাঁচ মাস আগে আমার ওজন ছিল ৫৬ কেজি। আজ আমি মাত্র ৪৬ কেজি।

তিনি জানান, তিনি মাসের পর মাস ধরে কোনো ফল বা মাংস খাননি এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রায় সব সঞ্চয় খরচ করে ফেলেছেন। আসিল তার ননদের সাথে থাকেন। ননদের এক মাস বয়সী একটি সন্তান আছে। তিনি জানান তার ননদ মরিয়া হয়ে সাশ্রয়ী দামে শিশুদের গুঁড়া দুধ খুঁজছে।

তিনি জানান, যদি এটি পাওয়া যায়ও এর প্রতি ক্যানের দাম পড়ে ১৮০ শেকেল বা ৩৯ ইউরো। আমার কাছে কোনো খাদ্য মজুদ করা নেই, এক-দুই সপ্তাহের মতোও না। হাজারো মানুষের মতো আমরাও দিন গুণে বেঁচে আছি।

সেভ দ্য চিলড্রেনের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার শাইমা আল-ওবাইদি বলেন, এখানে বসে এই (দুর্ভিক্ষের) ঘোষণাকে আপনার চমকপ্রদ কোনো তথ্য মনে হবে না। বিবিসির সাথে কথা বলতে গিয়ে আল-ওবাইদি বলেন, গত ২ মার্চ রমজান মাসে হঠাৎ করে সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় তিনি গাজায় ছিলেন। তিনি বলেন, আগের দিন অফিসে এত গুঞ্জন ছিল যে অবশেষে লেটুস বাজারে এসেছিল এবং সেদিন ইফতারের জন্য তারা কী সালাদ তৈরি করবে তা নিয়ে  আলোচনা হচ্ছিল ।

কয়েকদিনের মধ্যেই কোনো ধরণের প্রোটিন বা মাংস পাওয়া যায়নি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোনো তাজা ফল এবং কোনো তাজা শাকসবজি ছিল না এবং এক মাসের মধ্যে কোনো ময়দা ছিল না। যদি ময়দা পাওয়াও যেত তবে তা স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে পাওয়া যেত বলে উল্লেখ করেন তিনি। মানুষ ঘাস খাচ্ছিল, তারা পাতা খাচ্ছিল। তিনি বলেন, শিশুরা তাকে বলেছিল, তারা চায় তারা মরে যাক, যাতে তারা বেহেশতে গিয়ে খাবার খেতে পারে। কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সেখানে।

টিটিএন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved bijoykantho© 2025